মূলধনের ১০%-এর বেশি টাকা পুঁজিবাজারে খাটানো যাবে না
মূলধনের ১০ শতাংশের বেশি অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে অব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য নতুন আইন তৈরি হচ্ছে।
তবে কোনো প্রতিষ্ঠানের যদি অগ্রাধিকার শেয়ার থাকে আর সেই শেয়ারে বিনিয়োগ যদি কোম্পানির উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা মূলধনের (ভেনচার ক্যাপিটাল) অংশ হয়, তাহলে এই বিনিয়োগের পরিমাণ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধনের সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ হতে পারবে।
কিন্তু কোনোভাবেই সাধারণ ও অগ্রাধিকার শেয়ার মিলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ তার মোট আমানতের (দায়) ১০ শতাংশের বেশি হবে না।
বর্তমানে বিদ্যমান আইন ও বিধিবিধান অনুসারে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেয়ারবাজারে মূলধনের ২৫ শতাংশ এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন সাপেক্ষে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারে।
অন্যদিকে নতুন আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর একক কোনো কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ বিনিয়োজিত কোম্পানির পরিশোধিত মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত নির্ধারণ করা হয়েছে।
কিন্তু আইন প্রণয়নের দিনে এই হারের চেয়ে বেশি কোনো একক কোম্পানির শেয়ার কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকলে ১৫ দিনের মধ্যে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে।
এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্ধারিত সময়ে বিনিয়োগ উল্লিখিত আইনি সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে। তবে তা দুই বছরের বেশি হবে না বলে খসড়া আইনে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০০৮ সালে বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানগুলোর দেউলিয়া হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যায়। বাংলাদেশে ২০১০ সালের শেষ ভাগে শেয়ারবাজারে যে বিপর্যয় নেমে আসে, এর আগে ও পরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
সূত্রগুলো বলছে, শেয়ারবাজারের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ থেকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করা এবং সার্বিকভাবে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ভারসাম্য আনতে নতুন এসব ধারা যুক্ত হচ্ছে ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ২০১১’-এ।
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতিমধ্যেই নতুন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের খসড়া তৈরি করে তা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে। এটি এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর মন্ত্রিসভায় যাবে। পরে জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হলে বর্তমান ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন, ১৯৯৩’-এর স্থলে নতুন আইন প্রতিস্থাপিত হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রগুলো বলছে, নতুন আইন প্রণয়নে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বর্তমান আইনকে যুগোপযোগী করা, প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন আনা, বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বৃদ্ধি এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট সম্পদ, ঋণ, লিজ, বিনিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে গতিশীল ও ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে।
খসড়া নতুন আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানার ক্ষেত্রেও নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বর্তমান আইনের আওতায় বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা দিয়ে কোনো একক ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা একই পরিবারের হাতে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার যাতে কেন্দ্রীভূত না হয়, সে জন্য সীমা আরোপ করে রেখেছে।
নতুন আইনে তা সংযুক্ত করা হচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে: একক ব্যক্তি, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কেন্দ্রীভূত হতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদন নিতে হবে। কী উদ্দেশ্যে ৫ শতাংশের বেশি শেয়ার কেন্দ্রীভূত হবে, তা বিবেচনা করে দেখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই ধারা সংযুক্ত করেছে বলে সূত্র জানায়।
অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালকের সংখ্যা বিদ্যমান আইনের আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক নির্দেশনা দিয়ে ১৩ জনে সীমিত করে রেখেছিল, এটি আইনের মধ্যে আনা হচ্ছে। আর এ ক্ষেত্রে নতুন যুক্ত হচ্ছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পরিচালকের মেয়াদ কাল হবে তিন বছর। একজন পরিচালক দুই মেয়াদে সর্বোচ্চ ছয় বছর পর্যন্ত পরিচালক থাকতে পারবেন। পরে তাঁকে এক মেয়াদের জন্য বিরতি দিয়ে পুনরায় পরিচালক হওয়ার সুযোগও রয়েছে নতুন আইনের খসড়ায়।
খসড়া আইনে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সহযোগী বা সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে পরিষ্কার কিছু উদ্দেশ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো সাবসিডিয়ারি কোম্পানি গঠন করতে পারবে।
আমানতকারীর সঞ্চয়ের নিরাপত্তা রক্ষা ও জনস্বার্থে পরিচালকদের অপসারণের সুস্পষ্ট বিধান নতুন আইনে রয়েছে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে নীতিমালা ও শর্তাবলি স্পষ্ট ও যুগোপযোগী করা হচ্ছে নতুন আইনে। এ ক্ষেত্রে জনস্বার্থের বিষয়টি বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। একইভাবে শর্তাবলি পালন না করলে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা উপেক্ষাসহ বিধিবিধান লঙ্ঘনের কারণে লাইসেন্স বাতিলের বিধান রাখা হয়েছে নতুন খসড়া আইনে।
উল্লেখ্য, বর্তমানে দেশে ২৯টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। লিজিং কোম্পানি নামেই এগুলো অধিক পরিচিত পেয়েছে। ১৮ বছর আগের আইন দিয়ে এগুলো পরিচালিত হচ্ছে।
কিন্তু ব্যাংকগুলোর আন্তর্জাতিক মানসংক্রান্ত ব্যাসেল কমিটির ‘ব্যাসেল-২’ সুপারিশের আওতায় এখন আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আনা হচ্ছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের মূলধন সংরক্ষণের হার আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির আওতায় এসেছে। তা ছাড়া সময়োপযোগী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করতেও বিদ্যমান আইন সংশোধন করে নতুন আইন তৈরির সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা যায়।
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত ঋণ, অগ্রিম ও লিজ অর্থায়ন করে থাকে। খসড়া আইনে এসবের পাশাপাশি ক্রেডিট কার্ড, উন্নয়ন অর্থায়ন, নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ বা প্রচেষ্টায় বিনিয়োগ, ফ্যাক্টরিসহ ব্যবসা প্রসারের প্রস্তাব রয়েছে।
নতুন আইনে ইসলামি শরিয়াহ ভিত্তিতে পরিচালিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে কিছু পৃথক বিধান সংযোজন করা হয়েছে